এক মাস আগে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেপাল সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পাঁচ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,৭১ জন আরোহী নিয়ে উড়োজাহাজটি রানওয়ের একপাশে বিধ্বস্ত হওয়ার আগে পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল)যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল না।
পাইলট ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মধ্যে শেষ সময়ের ওই কথোপকথন নিয়ে গত ১২ মার্চ দুর্ঘটনার পর থেকেই আলোচনা চলছে।
দুর্ঘটনার দিনই ওই কথোপকথনের একটি অডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস ২১১ ত্রিভুবনে বিধ্বস্ত হওয়ার আগে ককপিটে বিভ্রান্তির আভাস পাওয়া যায় ওই কথোপকথনে।
নেপালের তদন্ত কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলেছে, উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৯ মিনিট ১০ সেকেন্ডে। দুপুর ২টা ১৭ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড পর্যন্ত পাইলটের সঙ্গে টাওয়ারের দ্বিমুখী যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবেই চলে।
এরপর ২টা ১৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত ককপিট ও টাওয়ারের মধ্যে আরও কিছু ট্রান্সমিশন হয়। কিন্তু কোনো পক্ষই অপরপ্রান্তের কথায় আর সাড়া দেয়নি।
কানাডার কোম্পানি বমবার্ডিয়ারের তৈরি ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয় আরও ২৫ সেকেন্ড পর।
পাইলট ও টাওয়ারের মধ্যে শেষ সময়ের যোগযোগের কী সমস্যা হয়েছিল, ঠিক কী কারণে উড়োজাহজটি দুর্ঘটনায় পড়ে- এসব বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদনে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি তদন্ত কমিশন। সেজন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ।
দুর্ঘটনার পরপরই নেপাল কর্তৃপক্ষ যে তদন্ত কমিশন গঠন করে, সালাউদ্দিন সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছেন। সেই সঙ্গে বেবিচকের গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বিকালে বেবিচক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে ওই প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন সালাউদ্দিন।
তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো দুর্ঘটনার পর এক মাসের মধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে হয়। সে অনুযায়ী গত ৯ এপ্রিল এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে নেপালের কমিশন।
আইকাওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা এক বছরের মধ্যে। তবে প্রয়োজনে ওই সময় আরও বাড়ানো যায়। সেক্ষেত্রে প্রতি বছর দুর্ঘটনার বার্ষিকীতে তদন্তের অগ্রগতি প্রকাশ করতে হয়।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও থাকে বলে জানান সালাউদ্দিন।
বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউএস-বাংলার ওই উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে নেপালের কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল ৬৭ জন যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে।
ত্রিভুবনে অবতরণের সময় ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ জনের মৃত্যু হয়, পরে হাসপাতালে মারা যান আরও দুজন। নিহত ওই ৫১ জনের মধ্যে ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি।
যে ২০ জন ওই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাদের সবাই গুরুতর দগ্ধ বা আহত হয়েছেন।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরের রানওয়ে, যেখানে ঘটেছে দুর্ঘটনা
যেভাবে দুর্ঘটনা
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে দক্ষিণ অংশের নাম দেওয়া হয়েছে রানওয়ে ০২; আর উত্তর অংশকে বলা হয় রানওয়ে ২০। পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শেষ চার মিনিটের কথোপকথনের ভিত্তিতে সে সময় বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছিলেন, কোন দিক দিয়ে রানওয়েতে নামতে হবে তা নিয়ে পাইলটের মধ্যে হয়ত বিভ্রান্তি কাজ করছিল।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি কমিশন। সেখানে বলা হয় রানওয়ে ০২ এর পূর্ব অংশে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ সীমানা বেড়ার ঠিক বাইরে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়।
ভূমি স্পর্শ করার সময় বিমানটি অবস্থান রানওয়ের মাঝ বরাবার ছিল না। মাটিতে নামার পর সেটি দক্ষিণ পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় এবং রানওয়ের বাইরের চলে যায়।
এরপর সীমানা বেড়া ভেঙে ঢালু জমি পেরিয়ে অবতরণের স্থান থেকে ৪৪২ মিটার দূরে গিয়ে থামে উড়োজাহাজটি। সেখানে বিমানটিতে আগুন ধরে যায় এবং পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
যা যা জানা গেছে
>> প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউএস বাংলার ১৬ বছরের পুরনো ওই উড়োজাহাজের এয়ারওয়ার্দিনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ৭ জুলাই পর্যন্ত। আর লাইন ম্যানটেইনেন্স সার্টিফিকেটের মেয়াদ ছিল ২৯ জুন পর্যন্ত।
>> ত্রিভুবনের রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে ও অবতরণক্ষেত্র ওই মডেলের উড়োজাহাজ নামার জন্য উপযুক্ত ছিল।
>> দুর্ঘটনার সময় সেখানে বইছিল পশ্চিমা বায়ু; হতি ছিল সাত থেকে আট নট। দৃষ্টিসীমা ছিলো ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার। ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে আকাশের নিচের অংশে বিক্ষিপ্ত মেঘ ভাসছিল। কাঠমান্ডু ভ্যালির দক্ষিণে ছিল বজ্রমেঘ। দক্ষিণপূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতেও দেখা গেছে।
>> দুর্ঘটনার দুই মিনিটের মধ্যে অগ্নিনির্বাপনকর্মী ও উদ্ধারকর্মীরা জ্বলন্ত বিমানটির কাছে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করেন।
তদন্ত কমিশনের বাংলাদেশি সদস্য সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনার আগে উড়োজাহাজটির পাইলটের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কথোপকথনে ‘গ্যাপ’ ছিল।
“কোনো উড়োজাহাজ নামার সময় যোগাযোগ দুই দিক থেকে হতে হয়। এক্ষেত্রে শেষ সময়ের কিছু কথোপকথন পাওয়া যায়নি।”
তিনি বলেন, উড়োজাহাজ, আবহাওয়ায় বা বিমানবন্দরের নেভিগেশন সিস্টেমে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না।
“কীভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেটা ধারণা করে বলা সম্ভব না। এই মুহূর্তে দুর্ঘটনার কারণ বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের ককপিট ভয়েস রেকর্ডার, ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার কানাডায় পাঠানো হয়েছে। সেখানেও বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার কারণ খোঁজার কাজ চলছে।